| |
               

মূল পাতা রাজনীতি ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা বিএনপির আন্দোলনে কী প্রভাব ফেলবে


২৮ অক্টোবরের সহিংসতা বিএনপির আন্দোলনে কী প্রভাব ফেলবে


রহমত নিউজ ডেস্ক     31 October, 2023     09:09 AM    


বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সর্বশেষ মহাসমাবেশে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা “একদিনের মধ্যে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে” বলে মনে করছে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির আন্দোলন আরো বেশি গতিময় হবে বলে আশা করছেন নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ২৮অক্টোবরের ঘটনা বিএনপির আন্দোলনে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে... এবং এটি আগামী আন্দোলনে নতুন করে আরো গতি এনে দিবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির উপর দোষারোপেরই সুযোগ বেশি এবং সরকার একে ফলাও করে প্রচার করে সেটি বিএনপির বিপক্ষে ব্যবহারের সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির সরকার পতনের দাবীতে যে আন্দোলন করে যাচ্ছে তা অর্জন না হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। এই অবরোধ কর্মসূচিগুলোতেও সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার জন্য পরস্পরকে দায়ী করে আসছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ।

শনিবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশের দিন ব্যাপক সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুই জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনার পর আটক করা হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরো অনেককে। বিএনপির ডাকে রবিবার সারাদেশে হরতাল পালিত হয়েছে। এই হরতালের সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ মোট তিন জন নিহত হয়েছে। রবিবারের হরতালের পর মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের সর্বাত্মক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।

রবিবার সংসদে তার দেয়া ভাষণে, শনিবারের সমাবেশে সহিংসতায় পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আর সোমবার বিকেলে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই সহিংসতার জন্য আওয়ামী লীগের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন।

বিএনপি ‘ব্যাকে’ চলে গেছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২৮শে অক্টোবরের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-দুই দলই সহিংসতা নিয়ে সতর্ক ছিল। বিশেষ করে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণার পর দুই দলই সতর্কতার সঙ্গে মাঠে থেকেছে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দেয়ার পরও রাজনৈতিক পরিবেশ শান্তই দেখা গেছে। কিন্তু ২৮শে অক্টোবর আসলে সেই শেষ রক্ষা হয়নি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, মনে করা হচ্ছে যে, ২৮ তারিখের ঘটনায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কিছুটা ‘ব্যাকে’ চলে গেছে। কারণ, 'সহিংসতার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা এবং পরে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় বিএনপির উপরে এক ধরনের দোষারোপের জায়গা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। আওয়ামী লীগও বলেছে, সহিংসতার মোকাবেলা করার জন্য সহিংসতাকেই বেছে নেয়া হবে। বিএনপির আগামী তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে এই তিন দিনই ‘শান্তি মিছিল’ করার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাড়া-মহল্লায় ‘পাহারা’ জোরদার করবে বলেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।

সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে জোবাইদা নাসরীন বলেন, সহিংসতার মনোভাব এখনো দুই দলেরই আছে। ২৮ তারিখ থেকে যেহেতু সহিংসতা শুরু হয়েই গেছে তাই বাড়তি চাপের একটা ধাপ তারা অতিক্রম করেই ফেলেছে। এখন থেকে সহিংসতা ও সংঘাতকেই কৌশল হিসেবে নিতে পারে বিএনপি ও তার সমর্থক অন্য দলগুলো। এদিকে আওয়ামী লীগ সহিংসতার এসব ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করে সেটি তাদের পক্ষে ব্যবহার করতে চাইছে।ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ২৮শে অক্টোবরের ঘটনাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে যে, এই সহিংসতার জন্য বিএনপির দায়ভার বেশি। সেখানে বিএনপির এই সহিংসতাকে সামনে এনে এটাকেই অবলম্বন করে আগানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। 'যে জায়গা থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো সেটা চলমান আছে। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি তিন দিন আছে। এর পর আরো কর্মসূচি দলটি দেবে। এই বাস্তবতায় মনে হচ্ছে, অবরোধকালীন সময়েও সহিংসতা চলতে পারে এবং সেটার প্রেক্ষাপট এরই মধ্যে তৈরি করেছে দলটি। আওয়ামী লীগও এমন অবস্থায় চুপচাপ থাকবে বা সংঘাত না করে সহিংসতা ও সংঘাত মোকাবেলা করবে সেটাও আশা করা যাচ্ছে না। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে, বিএনপি যতই বলুক যে নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না করে তারা ঘরে ফিরবে না, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি অর্জনের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এর জন্য বিএনপির নেতৃত্বের অভাব দায়ী। গত ২৮ অক্টোবরের বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতারা প্রচুর সংখ্যায় ঢাকায় আসলেও কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে খুব একটা সময় দাঁড়াতে পারেননি। তারা রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারেনি।' কাজেই নেতৃত্বের কারণে বিএনপি একদফার আন্দোলন কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটা বলাটা কঠিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, 'বিএনপি বরাবরই বলে আসছে যে তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু মহাসমাবেশগুলোতে পরিস্থিতি সব সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না।' অনেক সময় রাজনৈতিক সমর্থক যারা আছে, রাজনৈতিক কর্মী যারা আছে তারা অতি উত্তেজিত হয়ে যায়। তবে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে বিদেশি শক্তিগুলো বিমুখ হবে, এটা বিএনপির জন্য সুখকর হলো না আরকি যে এ ধরণের একটা ঘটনা ঘটলো।

বিএনপি যা বলছে
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা অবশ্য বলছেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনা তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারবে না। ময়মনসিংহ জেলার এক বিএনপি কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা মনে করেন না যে, ২৮ অক্টোবরের ঘটনার কারণে বিএনপির আন্দোলন পিছিয়ে পড়ার কোন সুযোগ তৈরি হতে পারে। বরং তারা বলছেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন সরকার পতনের আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন তারা। বিএনপির যতদিন একটা কর্মী বাইরে থাকবে, ততদিনই গণতন্ত্র রক্ষার কারণে ১০০ পারসেন্ট ভাবে তারা মাঠে থাকবে। আন্দোলন পেছানোর কোন সুযোগ নাই।

রংপুর মহানগর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জহির আলম নয়ন যিনি ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেছেন, তিনি বলেন, সরকার আসলে পূর্বপরিকল্পিতভাবেই সমাবেশে সহিংসতা ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনটাকে নেতিবাচক করার চেষ্টা করবে। আর আমরা এটাকে ইতিবাচক করার চেষ্টা করবো।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, বিএনপি গত এক বছর ধরে যে আন্দোলন করে যাচ্ছে তাতে একবারের মতোও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনি। এই এক বছর ধরে বিএনপি রাজনীতির যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আন্দোলন করে আসছে সেটাকে গত ২৮শে অক্টোবর বদলে দেয়া হয়েছে। মাত্র একদিনেই বাংলাদেশের পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। পরিবর্তিত পরিবেশেও বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাবে। আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের একটা নীতিগত মানসিকতা রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে, গণতন্ত্রের উদ্ধার প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ হবে। আমার এন্ডটা ভাল হবে কাজেই আমি সেটা অর্জন করার জন্য ভাল-খারাপ সব রকমের পন্থা অবলম্বন করবো সেটা আমরা নীতিগতভাবে সঠিক মনে করি না।

এদিকে সোমবার অন্তত সাতটি দেশের দূতাবাস থেকে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, কোরিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া এই বিবৃতিতে বলা হয়, দেশগুলো ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সব পক্ষকে সহিংসতা এড়িয়ে এক সাথে কাজ করে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশদারীত্বমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান জানানো হয়েছে। মঈন খান বলেন এই বিবৃতির সাথে তারা একমত।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতা কারাগারে রয়েছেন। এমন অবস্থায় আন্দোলনে কোন প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে ড. মঈন খান বলেন, বিএনপির রাজনীতি কোন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এই গ্রেফতারের কারণে আন্দোলন প্রভাবিত হবে না বলেও মনে করেন তিনি। কাকে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে নিয়ে গেলো, কার উপরে জুলুম চালালো সেটার কারণে বিএনপির আন্দোলনের গতিপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যাবে, এটা কল্পনা করা আকাশকুসুম (চিন্তা)। বিএনপির আন্দোলনে গত ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার ঘটনাগুলো অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। এই ঘটনা বিএনপির আগামী আন্দোলনে আরো নতুন করে গতিময়তা এনে দিবে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলন সহিংসতা দিয়ে দমানো যাবে না। আরও তীব্র মনোবল, দৃঢ় অঙ্গীকার ও সুসংগঠিত জনসমর্থন নিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী তিন দিন সারা দেশে সর্বাত্মক অবরোধ চলবে। এই অবরোধ কর্মসূচি রেলপথ রাজপথ, মহাসড়ক, সড়ক ও নৌপথে সর্বাত্মক অবরোধ চলবে। সর্বাত্মক বলতে, রাজধানীর সাথে জেলার সংযোগ সড়ক, জেলার সাথে উপজেলা, বা উপজেলার সাথে ইউনিয়নের যে মেইন সড়ক- সমস্ত সড়কে অবরোধ হবে, রেলপথগুলোতে অবরোধ হবে, নৌপথগুলোতে অবরোধ হবে। তবে এই অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে সংবাদপত্রের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবহনের গাড়ি।


সূত্র : বিবিসি বাংলা